ছবি: সংগৃহীত
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সাবেক চেয়ারম্যানকে সরাসরি দুর্নীতি, অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ উঠার পর সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেন। এর মধ্য দিয়ে দুদকের অভ্যন্তরেই প্রথমবারের মতো শীর্ষ পর্যায়ের এক প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিজস্ব উদ্যোগে অনুসন্ধান শুরু হলো, যা সংস্থাটির কার্যক্রমে নতুন দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দুদক সূত্রগুলো জানিয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের বহুল আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গে ইকবাল মাহমুদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ও ব্যবসায়িক সংযোগের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে ইকবাল মাহমুদের ভাই সাদিক মাহমুদ বকুলের সঙ্গে মিঠুর নিবিড় ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং তাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ দুদকের নজরে আসে। অভিযোগ রয়েছে, ইকবাল মাহমুদের অবস্থান ও প্রভাবের কারণে মিঠু ও বকুল বহু বছর ধরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করলেও তারা আইনের আওতার বাইরে ছিলেন।
সূত্র জানায়, মিঠু এবং বকুলের এ যোগসাজশের কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে ইচ্ছামতো কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারা, অতিরিক্ত বিল সংযুক্ত করে লুটপাট এবং অযোগ্য ঠিকাদার নিয়োগে প্রতিনিয়ত প্রভাব বিস্তৃত হতো। এই প্রভাব বিস্তারের পেছনে ইকবাল মাহমুদের অবস্থান ছিল অন্যতম মূল ভিত্তি—এমন মন্তব্যও পাওয়া গেছে বিভিন্ন কর্মকর্তার।
ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগগুলোর একটি হলো, ঠিকাদার মিঠুর কাছ থেকে রাজধানীর গুলশানের অভিজাত এলাকায় দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট গ্রহণ করা। অভিযোগ অনুযায়ী, এসব ফ্ল্যাট সরাসরি আর্থিক লেনদেন বা পরোক্ষভাবে সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে তার দখলে যায়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা হবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুস্পষ্ট উদাহরণ। দুদক এখন এই সম্পত্তির মালিকানা, ক্রয় প্রক্রিয়া, অর্থের উৎসসহ সব তথ্য খতিয়ে দেখছে।
এছাড়াও, তার ভাই সাদিক মাহমুদ বকুলের সম্পদের উৎস যাচাইয়ের কাজও একযোগে চলছে। দুদকের ধারণা, বকুলের বিপুল সম্পদের একটি অংশ মিঠুর মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির প্রধান অভিযুক্ত ঠিকাদার মিঠুকে গত ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারের পরে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রিমান্ডে দেওয়া মিঠুর জবানবন্দিতে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়, যার ভিত্তিতেই সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়। মিঠু জানিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় থেকে স্বাস্থ্য প্রকল্পে অনিয়ম করেছেন এবং কীভাবে ইকবাল মাহমুদের পরিবারের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
মিঠুর দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দুদকের অনুসন্ধান টিম নিশ্চিত হয় যে অভিযোগগুলো প্রাথমিকভাবে সত্যের ভিত্তি রয়েছে। এরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে সাবেক চেয়ারম্যানকে টার্গেট করে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
একই দিনে দুর্নীতি দমন কমিশন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ শিকদারের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং বেআইনিভাবে সম্পত্তি ভোগদখলের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় মামলা রুজুর অনুমোদন দেওয়া হয়।
দুদক জানায়, ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আব্দুর রশিদ শিকদার কমিশনে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। তিনি ৯,৬৬,৩৪,৫৩২ টাকার সম্পদের তথ্য দেন। তবে অনুসন্ধানে তার নামে ৯,৩৬,৪২,৯০৩ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি তার পারিবারিক ব্যয় হিসাব করা হয় ৮৯,১৫,১৩৪ টাকা। সব মিলিয়ে তার মোট সম্পদ দাঁড়ায় ১০,২৫,৫৮,০৩৭ টাকা।
অন্যদিকে তার বৈধ আয়ের পরিমাণ পাওয়া যায় মাত্র ৩,২৩,৪৩,৬৩১ টাকা। ফলে তার আয়-ব্যয়ের তুলনায় ৭,০২,১৪,৪০৬ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত এবং ভোগদখলে রাখার প্রমাণ মিলেছে বলে দুদক জানায়।
বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে দুদক দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার মুখে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে সংস্থাটি উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রভাবশালী ঠিকাদার ও শীর্ষ আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকে বিশেষজ্ঞরা ‘দুদকের জন্য বড় পরীক্ষা’ হিসেবে দেখছেন। কারণ, এটি প্রমাণ করবে সংস্থাটি নিজের ঘরেও একই মানদণ্ড প্রয়োগ করতে সক্ষম কিনা।
দুদক সূত্র জানায়, কোনো পদ-পদবি, পরিচয় বা প্রভাব কাউকেই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে—এমন নীতি অনুসরণ করেই সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে।
ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম দুদকের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ও সাহসিকতার নতুন দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের বহুল আলোচিত দুর্নীতির জট খুলতে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রশিদ শিকদারের বিরুদ্ধে মামলা রুজু দুদকের চলমান অভিযানকে আরও শক্তিশালী করবে বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
পুরো ঘটনাপ্রবাহ এখন জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এই অনুসন্ধান ও মামলার পরবর্তী অগ্রগতি বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



