ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষ হতেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে অর্থ বিভাগ। শুরুতে যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা—তার ওপর আরও প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। চার মাসে রাজস্ব সংগ্রহে ধারাবাহিক ঘাটতির পরও কীভাবে এবং কোন যুক্তিতে সরকার এত বড় অঙ্কের অতিরিক্ত লক্ষ্য দিল—এ নিয়ে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা।
প্রথম চার মাসেই ১৭ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর—এই চার মাসে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ দশমিক ৭ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ টার্গেটের তুলনায় ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো।
সাধারণত প্রতিটি অর্থবছরেই এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পিছিয়ে থাকে। চলতি বছরও সেই ধারাবাহিকতা আগেই দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থবছর শেষ হওয়ার অনেক আগেই রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়াকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন।
অর্থ বিভাগ বলছে—বাজেট ঘাটতি পূরণ জরুরি
অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, সরকারের সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত টার্গেটে রাজস্ব বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। টাকা সংগ্রহ না হলে
-
বড় অঙ্কের ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারকে আরও বেশি ঋণ নিতে হবে,
-
অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর চাপ বাড়বে,
-
ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট গভীরতর হতে পারে,
-
এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা আরও বাড়তে পারে।
এ কারণে মধ্যবর্তী সময়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে এনবিআরকে আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের দাবি—মূল টার্গেটই পূরণ হবে না
অন্যদিকে এনবিআর বলছে, শুরুতেই যে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল, সেটি অর্জন করাই প্রায় অসম্ভব।
কারণ—
-
বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দা,
-
আমদানি কমে যাওয়া,
-
ভ্যাট ও কর আদায়ে ধীরগতি,
-
ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা,
-
এবং বিনিয়োগ অনিশ্চয়তা—
সব মিলিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ চাপের মুখে।
তার ওপর লক্ষ্যমাত্রা অতিরিক্ত ৫৪ হাজার কোটি বাড়িয়ে দেওয়ায় আদায়-ব্যবস্থাপনা আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে।
গত বছরের অভিজ্ঞতা: লক্ষ্যমাত্রা কমতে কমতে টার্গেটই বদলে যায়
২০২৪–২৫ অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরের আদায়ের টার্গেট ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকারবিরোধী আন্দোলন, সংঘাত–সহিংসতা, ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা, আমদানি হ্রাস—সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক প্রবাহ কমে যাওয়ায় রাজস্ব আদায় বড় ধরনের ধাক্কা খায়। ফলে সরকার বছরের মাঝামাঝি সময়ে লক্ষ্য কমিয়ে আনে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায়। এরপর আরেক দফায় কমিয়ে হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি—শেষ পর্যন্ত সেটিও ধরে রাখা যায়নি। সর্বশেষ সংশোধনে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নেমে আসে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটিতে। অর্থাৎ পুরো বছরে কম আদায় হয় প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, গত বছর লক্ষ্য বারবার কমাতে হয়েছে বলেই ‘ঘাটতি’ ততটা বড় দেখায়নি। কিন্তু প্রকৃত আদায়-ক্ষমতা মোটেও আশাব্যঞ্জক ছিল না।
নতুন লক্ষ্যমাত্রা মানে আগামী ৮ মাসে বিশাল চাপ
এনবিআর সূত্র বলছে, ৫ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার নতুন লক্ষ্য ঠিক হওয়ায় আগামী আট মাসে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫২২ কোটি টাকা।
সংশোধনের আগের হিসাবে পরবর্তী সময়ে আদায়ের প্রয়োজন ছিল ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মাত্র আট মাসে অতিরিক্ত ৭২ হাজার কোটির মতো বেশি আদায় করতে হবে।
সময়ের তুলনায় এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত কি না—সেটি নিয়ে দফতরের অভ্যন্তরে সংশয় দেখা দিয়েছে।
দপ্তরগুলোর কাছে চাওয়া হয়েছে খাতভিত্তিক পরিকল্পনা
গত ২০ নভেম্বর গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের জারি করা এক চিঠিতে এনবিআরের অধীন সব দপ্তরের কাছে খাতভিত্তিক, খাতনির্ভর এবং মাসভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে ২৭ নভেম্বরের মধ্যে হার্ডকপি ও সফটকপি আকারে পরিকল্পনার নথি পাঠাতে বলা হয়েছে।
অর্থাৎ বাড়তি রাজস্ব আদায়ে মাঠপর্যায়ের সব ইউনিটকে দ্রুত কর্মপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
অর্থনীতিবিদদের মতে—
-
বাস্তবতা যাচাই না করে টার্গেট বাড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ,
-
উচ্চ লক্ষ্য ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ হিসেবে পড়তে পারে,
-
কর জোরদার করার পরিবর্তে কর-নীতি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ডিজিটাল নজরদারি এবং তথ্যভান্ডার শক্তিশালী করা জরুরি,
-
অন্যথায় বাজেট ঘাটতি যেমন থাকবে, তেমনি এনবিআরের ওপর আস্থাও কমতে পারে।
বছরের শুরুতে সংগ্রহ কম, চার মাসেই নতুন টার্গেট, সামনে আট মাসে বিশাল অঙ্ক আদায়—সব মিলিয়ে এনবিআর এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। সরকার ঘাটতি কমাতে যে লক্ষ্য বাড়িয়েছে, তা কতটা অর্জিত হবে—এখন দেশজুড়ে নজর সে দিকেই।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



